দৈনিক বঙ্গবন্ধু দেশ বার্তা : বিদ্রোহী কবি খ্যাত নজরুল ইসলামের ১২৫ তম জন্ম আজ। ক’দিন আগে থেকেই অন্যরকম করে সেজেছে কবির জন্মস্থান চুরুলিয়া। প্রত্যেক বছরের মতো এবারও কবি জন্ম ভিটায় দুবাংলার বাঙালিরা এসে মিশেছেন, কবি নজরুলের টানেই। কবির জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আবেগময় সহযোগিতা করছে আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। কবির ভাইপো কাজী রেজাউল করিম বলেন, দু’তিন বছর আগে আমরা কবি নজরুলের জন্মদিনের এই অনুষ্ঠানটিকে সমর্পণ করেছি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়কে। তারা দায় ও দায়িত্বের সঙ্গেই জন্মদিনের অনুষ্ঠানটি পালন করেন। কবির ভাইপো রিজাউল করিম বলেন, এবছর কবির জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে বহুমানুষ এসেছেন। এবার মেলা চলবে ৫ দিন।
তিনি বলেন, আমাদের কাজী নজরুল একাডেমির দেওয়া নজরুল পুরস্কার, সভ্যসাচী পুরস্কার, অনিরুদ্ধ পুরস্কার, প্রমীলা পুরস্কার দেওয়া তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে সরকারি নির্দেশে। এটি চালু করা হোক। দুই বাংলার কৃতীসন্তানদের এই পুরস্কার দেওয়া হত। জিজ্ঞেস করলে কাজী রিজাউল করিম আরও বলেন,“পারিবারিক নজরুলে আমি খুব তৃপ্ত। আমাদের সুবর্ণ গান করে, সোনালী গান করে কবির গান। কবির জন্য তাঁদের পরিচিতি হয়েছে। এসবই নজরুলের টানেই, আমরা আজও মেতে থাকি। কবি নজরুলরা তিন ভাই ছিলেন।
কাজী রিজাউল মেতে ছিলেন কবিকে নিয়ে, বলছিলেন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার গল্প। কবি জীবনের গল্প। বললেন, আপনাদের কবি কাজী নজরুলরা তিন ভাই। কাজী সাহেব যান, নজরুল ইসলাম, কাজী আলী হোসেন। তিন ভাই এক বোন উম্মেকুলসুম। আমি কাজী আলী হোসেনের মধ্যম ছেলে, কাজী রিজাউল করিম। কবি নজরুল ইসলাম আমার জ্যাঠামশাই ছিলেন। তাঁর সচেতন অবস্থায় থাকার কথা আমার তেমন মনে নেই, বলছিলেন রিজাউল বাবু। তিনি আরও বলেন,“আমি তাঁকে দেখেছি অনুভবে। ১৯৩৯ সালে আমার জন্ম। কবি নির্বাক হন ১৯৪২ এ। ফলে আমার জ্ঞান হতেই আমি তাঁকে দেখেছি বাকহীন। কেবল বসে থাকতেন। আর তাঁর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরত। তাঁকে খাইয়ে দেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, কয়েক বার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫৬ তে তাঁকে আনা হয় চুরুলিয়াতে। সেবার বড় আনন্দ হয়েছিল আমাদের। তাঁর প্রথম জন্ম উৎসব চুরুলিয়াতে হয় ১৯৪৬, তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা কাজী আলী হোসেন সে জন্ম উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। প্রথম কবির জন্মদিন পালন, চুরুলিয়াতে। তিন দিনের এই জন্ম উৎসবে সেবার এসেছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, সিদ্ধেশ্বর মুখার্জ্জীসহ আরও অনেকে। সে সময় ভারতবর্ষের স্বনামধন্য কবিয়াল গুমানী দেওয়ান ও লম্বধর চক্রবর্তীরাও এসেছিলেন চুরুলিয়ার অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠানটি হয় পশ্চিম বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামের নবকৃষ্ণ হাইস্কুল মাঠে, প্যান্ডেল করে।
কবিকে নিয়ে সেই প্রথম উম্মাদনা শুরু হয়েছিল চুরুলিয়ার গ্রামে। কাজী রিজাউল করিম বলেন, আমরাও সেবার বেশ আনন্দ করেছিলাম। তিনি আরও বলতে থাকেন, জীবনের ধূসর ইতিহাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমার কবির সঙ্গে কাটানোর কয়েকটা স্মৃতি এখনও মনে আছে। আমি তখন মেট্রিক পরীক্ষা দেব। পয়সা নেই। তখন আমি সে কথা জ্যাঠাইমা প্রমীলাকে জানালে, তিনি আমাকে তাঁর কাছে ডেকে নেন। তখন কবিকে নিয়ে, প্রমীলারা থাকতেন কলকাতার মানিকতলায়। আমি গিয়ে তাঁর কাছে উঠি। সে বার মাস দুয়েক তাঁদের কাছে ছিলাম। তিনি পরীক্ষার খরচ দেন। তখন দেখেছিলাম, আমার জ্যাঠামশাই নজরুল ইসলামের কিছু ঘটনা। এখনও মনে আছে সে সব। সবথেকে মজার ঘটনা হল, ঘড়িতে বেলা ১২ টা বাজলেই কবি হাত দুটো উপরের দিকে তুলতেন। তারপর জামা খোলা হত। তিনি তখন হনহন করে চলে যেতেন স্নানের ঘরে। তারপর স্নান হলে, জামা কাপড় কবিকে পড়িয়ে দেওয়া হলে কবি এসে আসনে বসতেন। এবং প্রমীলা দেবী নিজের হাতে তখন খাইয়ে দিতেন কবিকে। আমিও সে সময় কয়েক বার কবিকে খাইয়ে দিয়েছি। স্নান করিয়ে, জামাকাপড় পড়িয়ে, চুল আঁচড়েও দিয়েছি। সে সময় দেহের ভগ্ন দশা। মাথার চুলও আগের মতো নেই। কমে গেছে। কেবল স্থির চোখে, নিষপলক তাকিয়ে থাকতেন। আর দেখতেন। আকাশ আর প্রকৃতির দিকেই তাকিয়ে থাকতেন সর্বক্ষণ।
কাজী রিজাউল করিম আরও বলেন,“আমি অনেক সময় দেখেছি, তাঁর গান কেউ তাঁর সামনে গাইলে তিনি হাতের কাছে পরে থাকা ফুল, মালা তাঁর দিকে ছুঁড়ে দিতেন। আনন্দ খেলত মুখেচোখে তখন তাঁর। কখনও কখনও নির্বাক কবি গান শুনে তাঁর দিকে তাঁকিয়ে হারমোনিয়ামটি ইশারা করে বাজাতে বলতেন। নিজের গান শেষ জীবনে খুব শুনতে পছন্দ করতেন কবি।”
কবিকে যখন বাংলাদেশ নিয়ে যাওয়া হল, কাজী সভ্যসাচী এবং অনিরুদ্ধর অনুমতি নিয়ে। ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে। কাজী রিজাউল করিম বলেন, আমাদের পরিবার তখন কবিকে ফেরাতে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় ধর্নাও দিয়ে ছিলাম। কথাও দিয়ে ছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্যসংস্কৃতি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ শঙ্করের জমানায় সেই মন্ত্রী। তিনি কবিকে ফিরিয়ে আনবেন ভারতে, সে কথা বলেছিলেন পরিবারের সদস্যদের কাছে। তবে তার কয়েক দিনের মধ্যেই কবি বাংলাদেশের মাটিতে ইহলোক ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে আছে তার সমাধি। বলছিলেন রিজাউল করিম।
চুরুলিয়ার মাটিতে কবির ফেরা না হলেও সেখানে কল্পিত কবর আছে। এ বিষয়ে রিজাউল করিম বলেন,“আমরা প্রমীলা দেবীর সমাধির পাশেই কবির একটি কল্পিত সমাধি রচনা করেছি চুরুলিয়ার মাটিতে। কাজী সভ্যসাচী বাংলাদেশ থেকে কবির কবরের মাটি থেকে এক মুঠো মাটি এনে চুরুলিয়ার কল্পিত সমাধি রচনা করা হয়। আজও আমরা এখানে যে কোনো অনুষ্ঠান করার আগে, কবির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করি।”
Leave a Reply