দৈনিক বঙ্গবন্ধু দেশ বার্তা : অনন্য এক দেবদুলাল মুখোপাধ্যায় ছোটবেলায় থাকতেন শান্তিপুরে। পরিবারে ব্যাপক অর্থকষ্ট ছোট ছেলেটি বুঝল কাজে না ঢুকলে পরিবারের হাল ফেরানো অসম্ভব পড়াশোনা ছেড়ে পাড়ি দিলেন কলকাতা উঠলেন হ্যারিসন রোডের একটি মেসে। ওই মেসে ছেলেটির সঙ্গে থাকতেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। রোজগারের জন্য তখন যা পেতেন তাই করতেন। চায়ের দোকানের কাজ। রেল কোম্পানির হয়ে সার্ভে। অর্থকষ্ট এতটাই ভয়াবহ ছিল। তবে সৃষ্টিশীল মনটা তাতেও হারিয়ে যায়নি সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে রাতে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা কবিতা লিখেছেন
তিনি শিল্পী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৬০ সাল সুধীন দাশগুপ্তই দেবদুলালবাবুকে আকাশবাণীর ‘অনুষ্ঠান ঘোষক’-এর পদে চাকরির কথা বলেন। পরীক্ষা দিয়ে ঢুকেছিলেন। তারপর একটানা বত্রিশ বছর আকাশবাণীর সংসারে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
খবর পড়ায় একটা আলাদা ঘরাণা তৈরি করেছিলেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘ কলকাতার আকাশবাণীতে ‘‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়’’—ভরাট কণ্ঠের এই সম্ভাষণ আজও বাঙালির হৃদয়ে সংবাদ পাঠকে তিনি এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে, ঘরে ঘরে সংবাদ পরিক্রমা শোনার জন্য রেডিও খোলা হতো।
দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেডিয়ো-জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা সম্ভবত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্প্রচারটি। ১৯৬৬ সাল থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা চলে আসতেন কলকাতায়। তাঁরা সোজা গিয়ে দেখা করতেন আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগে। শোনাতেন নিজেদের অসহায় জীবনের নানা কাহিনী
আকাশবাণীর ‘সংবাদ পরিক্রমা’-র লেখক প্রণবেশ সেন আর সংবাদ পাঠক দেবদুলালকে সেই সব কাহিনী অসম্ভব বিচলিত করেছিল।
প্রতিদিন রাত দশটা থেকে দশটা পাঁচ মিনিট দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় পড়তে লাগলেন যুদ্ধের কথা। যন্ত্রণার ইতিহাস। যাঁরা রেডিয়োর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তাঁরা তো বটেই শ্রোতারাও জানেন কী প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়েছিল সে অনুষ্ঠান।
১৯৭২ সালে এই সংবাদ পাঠের জন্যই পদ্মশ্রী উপাধি পান দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন –
আকাশবাণীর খবর পড়তে গিয়ে মাঝেমধ্যে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারিনি। মনে হতো, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন আমার বুকের ভেতরের সব লুকানো আবেগ আর উত্তেজনা ঢেলে দিয়েছিলাম আকাশবাণীর সংবাদ, সংবাদ-পরিক্রমা বা সংবাদ-সমীক্ষা পড়তে গিয়ে। রণাঙ্গনের খবর যখন পড়তাম, তখন মনে করতাম, আমিও সেই রণাঙ্গনের সৈনিক, যখন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের কথা পড়তাম, তখন আমার মনের সমস্ত উল্লাস উচ্ছ্বাস নেমে আসতো আমার কণ্ঠজুড়ে। যখন করুণ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা পড়তাম, তখন কান্নায় জড়িয়ে আসত গলা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকটায় যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। উত্তেজনা আর প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কখন পড়বো বাঙলাদেশের খবর। এই খবর পড়ার জন্য কখনো কখনো রাতে বাড়িও ফিরিনি। রাত কাটিয়েছি আকাশবাণী ভবনে। ভোরের খবর পড়তে হবে যে!
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলাদেশ সরকার তাদের দেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়।
১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি একটি অনুষ্ঠানে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর অসামান্য সংবাদপাঠের জন্যে বুকে জুড়িয়ে ধরেন।
বাংলাদেশের মুক্তিসেনারা তাঁর নাম দিয়েছিলেন, ” বাংলার দুলাল” |সারা ভারতে এখনও পর্যন্ত যে তিনজন ব্রডকাস্টার পদ্মশ্রী পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য দু’জন- AIR-এর মেলভিন ডি মেলো (Melville de Mellow) এবং ঊষা মেহতা, যিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় গোপন বেতার কেন্দ্র চালাতেন।আজ দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রয়াণদিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি অহর্নিশ
তথ্য : আকাশবাণী কলকাতা খবর পড়ছি… (আনন্দবাজার পত্রিকা), উইকিপিডিয়া
Leave a Reply