দৈনিক বঙ্গবন্ধু দেশ বার্তা : মাদারীপুরের সদর উপজেলার চরমুগরিয়া বন্দরে মুক্তভাবে বেড়ে ওঠা ছোট-বড় প্রায় এক হাজারের ও বেশী বানর খাবারের জন্য শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাণীগুলোর অত্যাচারে অতিষ্ঠ শহর ও আসপাশের এলাকাবাসী। অনেকে মারধরও করছেন। এতে হুমকিতে পড়েছে বানরগুলো।গত মাসের ২৭ অক্টোবর থেকে সরকারিভাবে বানরদের খাবার দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে এতেও বানরগুলো চরগরিয়া এলাকায় ফিরে যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ভারতের নদীয়া ও শান্তিপুর থেকে অনেক বানর আসতো এ বন্দর এলাকায়। সেই বানরগুলো স্থায়ীভাবে মাদারীপুরের চরমুগরিয়া এলাকায় থাকতে শুরু করে। ওই সময় কয়েক হাজার বানর থাকলেও প্রকৃতি ও ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ করে বর্তমানে এই এলাকায় টিকে আছে প্রায় এক হাজারের মতো বানর।আগের মতো এই অঞ্চলের ফলদ গাছ না থাকায় চরম খাদ্যভাবে পড়েছে বানরগুলো। তবে চরমুগরিয়া বন্দরে কী পরিমাণ বানর রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। মাদারীপুর বনবিভাগ ও পশুসম্পদ বিভাগের মতে, চরমুগরিয়া বন্দরে বর্তমানে এক হাজারের মতো বানর আছে। স্থানীয়দের মতে, এ সংখ্যা প্রায় ১২০০।স্থানীয়রা জানান, একটা সময় এই বন্দরে কয়েক হাজার বানর ছিল। বানরগুলো চরমুগরিয়ায় ছয়টি ভাগে বিভক্ত হয়ে বসবাস করতো। এই স্থানগুলো হলো চরমুগরিয়া এলাকার কালীবাড়ি, জেটিসি, থানা বা ফাঁড়ি, জেমস একাডেমি, নদীর পাড় ও জমাদ্দার মিল এলাকা। বানরগুলো কালীবাড়ি, স্বর্ণকারপট্টিতে এক অংশ, চৌরাস্তা, নদীর পাড়ে এক অংশ এবং জেটিসি ও আদমজীতে আরেক অংশ থাকতো। এক অংশের বানর অপর অংশে প্রবেশ করতো না। ভুলক্রমে যদি কোনো বানর অন্য অংশে ঢুকে পড়তো তাহলে ঝগড়া লেগে যেতো বানরগুলো বর্তমানে ক্ষুধার তাড়নায় শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে এমনকি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও খাবারের দোকানে হানা দিচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যায় এখানকার বানর বিপন্ন হয়ে পড়ে। তখন বেশ কিছু বানর মারা যায়। ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় নবী সাহেব নামের একজন জুট অফিসার দীর্ঘদিন এদের খাদ্যর ব্যবস্থা করেন। বিষয়টি সাবেক জেলা প্রশাসক ফরহাদ রহমানের নজরে এলে বানরগুলো রক্ষায় তিনি সাবেক পরিবেশমন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে আবেদন জানান। মন্ত্রী তখন বানভাসি মানুসের পাশাপাশি বানরদের জন্য ত্রাণ মঞ্জুর করেন।
পরে ১৯৯৯ সাল থেকে আবার খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ২০০৩ সাল থেকে বেশ কয়েক বছর প্রায় প্রতি শুক্রবার ফ্রেন্ডস অভ নেচার নামের একটি সংগঠন বানরদের খাদ্য বিতরণ করে আসছিল। তাদের পাশাপাশি ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেসিডিপি নামের একটি বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মজিবুল হক দুলু প্রতিদিন ৫০০ টাকার খাদ্য বানরদের জন্য বিতরণ করতে থাকেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে সরকারি বনবিভাগ থেকে এক কোটি টাকার টেন্ডার আহ্বান করা হয়। তার মধ্যে প্রতিদিন বানরকে ১২ হাজার ৫০০ টাকার খাদ্য বিতরণ এবং থাকার জন্য স্থায়ী শেড নির্মাণ ও বিভিন্ন প্রকারের ফলফলাদির গাছ লাগানোর ব্যবস্থা ছিল। পরে ২০০৮ সালে বানরদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি শেড নির্মাণ করা হয়। তবে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গাছ লাগানো হলেও সংরক্ষণের অভাবে এগুলো মারা যায়। পরবর্তী সময়ে দুইবার বানরদের জন্য কিছু বরাদ্দ এলেও দীর্ঘদিন ধরে সরকারিভাবে কোনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়নি। এ সময় নতুন জন্ম নেওয়া বাচ্চাসহ অন্য বানরগুলোও মারা যায়। অনেক বানর খাদ্যের অভাবে জেলার বাইরেও চলে যায়। তবে গত ২৭ অক্টোবর থেকে আগামী এক বছরে জন্য সরকারিভাবে বানরের খাবারের জন্য ২৯ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে। মাদারীপুর বনবিভাগ থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে খাবার দেওয়া শুরু হলেও চরমুগরিয়া এলাকায় ফিরছে না বানরগুলো। ট্রেন্ডারের মাধ্যমে খাবার বিতরণের কাজ পায় শামীম ইন্টারন্যাশনাল। খাবার বিতরণ দেখাশোনার দায়িত্ব পান স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্নের সবুজ বাংলাদেশ’।
স্বপ্নের সবুজ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ইমরান মুন্সি বলেন, সপ্তাহে তিন দিন (রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার) খাবার দেওয়া হয়। প্রতিবার ৭০ কেজি কলা, ৪০ কেজি রুটি, ৪০ কেজি শসা ও ২৫ কেজি বাদাম দেওয়া হয়। তবে বানরগুলো চরমুগরিয়া থেকে শহরের দিক চলে যাওয়ায় তাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে। তবে আশা করছি নিয়মিতভাবে খাবার দেওয়া হলে বানরগুলো আবার নিজ এলাকায় ফিরে আসবে। সরেজমিনে দেখা যায়, মাদারীপুর বনবিভাগ চরমুগরিয়া এলাকার নয়াচরে একটি ইকোপার্ক তৈরি করেছে। সেই ইকোপার্কে বানরগুলোর জন্য অভয়ারণ্য তৈরি করা হবে। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে ইকোপার্কের কাজ হলেও জায়গার জটিলতায় দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ করা হয়নি। ফলে বানরগুলোকে সেখানে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এতে কোনো কাজে না এসেই ১০.৩৬ একরের ওপর গড়ে ওঠা ইকোপার্কটি নষ্ট হতে চলেছে।মাদারীপুরের স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ফ্রেন্ডস অব নেচারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাজন মাহমুদ বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশে জন্ম নেওয়া বানরগুলো আজ খাদ্যের অভাবে বিলুপ্তির পথে। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য সরকারসহ স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি বর্তমানে বানরে খাবারের জন্য যে বরাদ্দ এসেছে, তা যেন সঠিকভাবে পায় সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর রাখতে হবে। দ্রুত ইকোপার্কটি চালু করে বানরদের জন্য অভয়ারণ্য গড়ে তোলারও আহ্বান জানান তিনি। চরমুগরিয়া এলাকার বাসিন্দা রাসেল হাওলাদার বলেন, ‘কয়েক মাস আগেও চরমুগরিয়া এলাকায় অনেক বানর ছিল। এখন খাদ্যের অভাবে প্রাণীগুলো শহরের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকদিন হলো নতুন করে সরকারিভাবে খাবার দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বানরের সংখ্যা কম।’ মাদারীপুর জেলা বন ও পরিবেশ কমিটির সদস্য শাহজাহান খান বলেন, খাবারের জন্য বানরগুলো শহরে ঢুকে পড়েছে। মানুষজনের বাড়িতে হানা দিচ্ছে। যেহেতু আবার বানরদের খাবার দেওয়া হচ্ছে কিন্তু বানরগুলো ওই এলাকায় যাচ্ছে না, তাই বিকল্প কোনো উপায় খুঁজে বের করে বানরদের চরমুগরিয়া এলাকায় নিয়ে যেতে হবে। চরমুগরিয়া এলাকার খাবারের দোকানের মালিক আফজাল, কালাম, কলা ব্যবসায়ী ওহাব, মুদি দোকানদার মিলন, খুচরা ব্যবসায়ী সামাদসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, চরমুগরিয়ায় প্রায় এক হাজার বানর আছে। দিনে দিনে এই বানরগুলো খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছে। অনেক বানর আশপাশের জেলাগুলোতে চলে যাচ্ছে। তারা বলেন, বানরগুলোর অত্যাচারের আমরা অতিষ্ঠ। ওদের কারণে আমরা ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারি না। এক পলকের মধ্যে ছো মেরে খাবার নিয়ে পালিয়ে যায়। অনেক সময় বাধ্য হয়ে লাঠি দিয়ে মেরে তাড়াতে হয়। এদের সঠিকভাবে খাদ্যের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। জানতে চাইলে মাদারীপুর বনবিভাগের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বানরগুলোকে আবার খাবার দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি বানরগুলো ধীরে ধীরে চরমুগরিয়া এলাকায় আসবে।ইকোপার্কের বিষয়ে তিনি বলেন, জায়গা নিয়ে স্থানীয় কয়েকজন মামলা দিয়েছেন। তাই এই জটিলতায় দুই বছর ধরে কাজ বন্ধ আছে। আশা করছি দ্রুত সমাধান হলে আবার কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। তখন বানরদের জন্য একটি অভয়ারণ্য গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
Leave a Reply