দৈনিক বঙ্গবন্ধু দেশ বার্তা : মাদারীপুর মুক্ত দিবস উপলক্ষে মাদারীপুর জেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন সংগঠন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখযুদ্ধে মারা যাওয়া সবচেয়ে ছোট সদস্য শহীদ সরোয়ার হোসেন বাচ্চুর কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন খলিল বাহিনীর প্রধান সাবেক পৌর চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান খান, মুক্তিযোদ্ধা ফোরামের সভাপতি সাজাহান হাওলাদার, মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর কবির প্রমুখ। পরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি শোভাযাত্রা বের হয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। এছাড়াও মাদারীপুরের সভাপতি মো. বায়জীদ মিয়ার নেতৃত্বে অসহায়দের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ, স্বপ্নের সবুজ বাংলাদেশের সভাপতি মো. ইমরান মুন্সির নেতৃত্বে গাছের চারা বিতরণ, নকশি কাঁথার সদস্য কেএম জুবায়ের জাহিদের নেতৃত্বে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তখন স্থানীয় সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজে (বর্তমান নাম সরকারি মাদারীপুর কলেজ) এয়ারফোর্সের অবসরপ্রাপ্ত অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আলমগীর হোসাইনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক ট্রেনিং শুরু হয়। ১৭ এপ্রিল দুপুর ২টায় মাদারীপুর শহরে দুটি বোমারু বিমানের সাহায্যে উপর্যপুরি বোমা হামলার পর ১৯ এপ্রিল মাদারীপুর শহরে পাক হানাদার বাহিনীর প্রবেশের আগ পর্যন্ত মাদারীপুর মুক্ত থাকে। আলমগীর হোসাইনের ট্রেনিংয়ের এক সপ্তাহ পর ক্যাপ্টেন শওকত (পরবর্তীতে কর্নেল হিসেবে অবসর প্রাপ্ত) ও স্টুয়ার্ড মুজিব (দেশ স্বাধীনের পরে ভারতীয় মিত্র বাহিনী দ্বারা নিহত) ও খলিল কেরানিসহ ১৫-১৬ জনের একটি দল উন্নত ট্রেনিংয়ের জন্য নোয়াখালী দিয়ে ভারতের অন্বিকাপুর যান। সেখানে ১০-১২ দিন ট্রেনিং দিয়ে দেশে আসেন।
এলাকার সাবেক পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্য, আনসার, কৃষক, ছাত্রসহ সর্বস্তরের জনতা এক হয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন। পাক হানাদার বাহিনী দালাল, রাজাকার, আলবদর, মুজাহিদ বাহিনীর সহায়তায় গোটা এলাকায় নির্যাতন চালায়। স্থানীয় এ.আর. হাওলাদার জুট মিলে ক্যাম্প তৈরি করে হত্যা, লুট, ধর্ষণসহ বিভিন্ন পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। কিন্তু এ অত্যাচার নির্যাতনে মুক্তিযোদ্ধারা দমে না গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।আগস্ট মাসে মাদারীপুর ফরিদপুরের সড়ক পথের তিনটি ব্রিজ সিদ্ধিরখোলা, চোকদার ও সমাদ্দার ব্রিজ এক্সক্লুসিভের দ্বারা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিজগুলো লোহার স্ট্র্যাকচার দিয়ে কোনো রকম হালকা যানবাহন চলার উপযোগী করা হয়েছিল। সবশেষ যুদ্ধ সংঘটিত হয় সমাদ্দার এলাকায়।
৬ ডিসেম্বর গভীর রাতে রাওফরমান আলীর নির্দেশে ব্রিগেডের হেড কোয়ার্টার ফরিদপুর সেনা নিবাসের আশপাশের পাঁচ জেলার সব পাকসেনাদের ফরিদপুর চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তৎকালীন মাদারীপুর মহাকুমার এস.ডি.ও মতিন সাহেবের ড্রাইভার আলাউদ্দিন মিয়া (মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্স) মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্প, চৌহদ্দি ক্যাম্প, আমগ্রাম ক্যাম্পসহ সব ক্যাম্পের পাকসেনাদের ফরিদপুর সেনানিবাসে চলে যাওয়ার গোপন সংবাদটি পৌঁছে দেন। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মেজর খলিলের নেতৃত্বে সমাদ্দার এলাকাটি ঘিরে ফেলেন।
ঘটকচর থেকে জিপ ও ট্র্যাকের আড়ালে পায়ে হেটে হেটে পাকসেনারা মেজর আ. হামিদ ঘটকের নেতৃত্বে সমাদ্দার ব্রিজ পার হওয়ার জন্য এগিয়ে যেতে থাকেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পায়ে হেটে জমাদ্দার ব্রিজ পার হয়ে ট্র্যাক ও জিপে উঠে ফরিদপুর চলে যাওয়ার। ৭ ডিসেম্বর সংবাদ পাওয়ার পরেই মুক্তিযোদ্ধারা উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সমাদ্দার এলাকা ঘিরে রেখেছিলেন। প্রধান সড়কের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে মুক্তিযোদ্ধারা বাংকার করে রেখেছিলেন। পাকসেনাদের গাড়িটি ব্রিজে উঠার সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টিট্যাংকমাইনের আঘাতে ব্রিজ ভেঙে তারা গাড়িসহ পানিতে পড়ে যায়। দ্রুতগতিতে পাকসেনারা পূর্বদিকে আগেই তৈরি করে রাখা ছয়টি বাংকারে আশ্রয় নেয়।
৯ ডিসেম্বর সারাদিন সারারাত তুমুল যুদ্ধের পর পাকসেনাদের বাংকারে খাদ্যের রসদ ফুরিয়ে গেলে তারা সাদা পতাকা তুলে সন্ধির প্রস্তাব দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সিজ ফায়ারের সুযোগে গাড়িতে রাখা খাদ্য দ্রুতগতিতে বাংকারে নিয়ে আসে। ১ ঘণ্টা বিরতিতে পাকসেনারা আবার ফায়ারিং শুরু করে।
১০ ডিসেম্বর সকাল ৯টার দিকে মেজর খলিল যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করেন। কৌশল হিসাবে উপর্যপুরি গ্রেনেড হামলার সিদ্ধান্ত নেন। মাদারীপুর মুক্তিযোদ্ধাদের সবার প্রিয় এবং সকলের ছোট একমাত্র সদস্য সরোয়ার হোসেন বাচ্চু নিজেই মেজর খলিলের কাছে আবদার করেন, তার সঙ্গে বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করতে যাওয়ার জন্য। সব বাধা অগ্রাহ্য করে সে কমান্ডারের সঙ্গে যান। সে উপর্যপুরি গ্রেনেড ছুড়তে থাকেন। ৩৮টি গ্রেনেড চার্জ করার পর ৩৯ গ্রেনেড চার্জের সময় পাকসেনাদের সরাসরি গুলির আঘাতে বাচ্চু প্রাণ হারান। তাকে সমাধিস্থ করার জন্য মাদারীপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজের প্রবেশ মুখে তাকে কবর দেওয়া হয়।
১০ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার দিকে পাকসেনাদের খাদ্য ও গোলাবারুদের রসদ শেষ হয়ে গেলে তাদের মনোবল একেবারেই ভেঙে যায়। তারা আত্মসমর্পণ করার জন্য সংকেত পাঠায় এবং আত্মসমর্পন করে। রাতের বেলায় মেজর খলিল পাকসেনাদের ডিসআর্মড না করে পরের দিন ১১ তারিখ সকালে মেজর ঘটক মুক্তিযোদ্ধা মেজর খলিলের কাছে তার ক্যাপ, বেল্ট ও পিস্তল খুলে জমা দেন ও আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। ৩৯ জন পাকসেনা এবং ১৫ জন রাজাকার, মুজাহিদসহ মেজর ঘটক আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের পর মুক্তিযোদ্ধারা ১৫ জন রাজাকার ও মুজাহিদদের পায়ের তলায় পৃষ্ট করে মেরে ফেলেন। ঐদিন পাকসেনাদের মুক্তিযোদ্ধারা কেন্দুয়া ইউনিয়নের কলাগাছিয়া হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসেন।
১১ ও ১২ ডিসেম্বর ঐ ক্যাম্পে সবাই অবস্থান করেন। ১৩ ডিসেম্বর সরোয়ার হোসন বাচ্চুর মাজারে নিয়ে আসেন। ঐখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে নিয়ে আসেন। সেখানে খাওয়া দাওয়া ও শীতবস্ত্র পড়ানোর পর আহত সেনাদের চিকিৎসার জন্য সদর হাসপাতালে এবং সুস্থ সেনাদের মাদারীপুর জেলে পাঠায়।২৮ ডিসেম্বর তাদেরসহ আশেপাশের পাঁচ জেলার আত্মসমর্পণ করা পাকসেনাদের ফরিদপুর এসপির নেতৃত্বে ঢাকায় পাঠানো হয়। এভাবেই মাদারীপুর হানাদার মুক্ত হয়।
Leave a Reply